Tuesday, July 21, 2020

নূরানী টাইপ ও সৌদি আরব টাইপ (সৌদী আরবের কিং ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স মুদ্রিত) কুরআনের মধ্যে যা মদীনা মাসহাফ (মদীনা মাসহাফ কাকে বলে বিস্তারিত এই লিংকে) নামে পরিচিত খুব বেশি পার্থক্য নেই। দুটি কুরআন'ই  'উসমানী মাসহাফ' এর কিছু পরিবর্তিত রুপ। মাসহাফ নিয়ে আলোচনা করা ও বোঝার সময় অবশ্যই একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে এটা কুরআনের ভাবার্থের পার্থক্যের বিষয় নয়, দুনিয়ার সব কুরআন ও মাসহাফের শব্দ, বাক্য ও অর্থ এক। মাসহাফের পার্থক্য বলতে আসলে বোঝায় কুরআন ৭ কিরাতে (৭ নিয়মে পড়ার অনুমতিসহ) নাযিল হয়েছে। একই শব্দ বা বাক্য একেক মাসহাফে একটু ভিন্ন রকমভাবে উচ্চারণ করা হতো। কিন্তু উসমান (রা:) এর সময়ে বিশৃংখলা সৃষ্টি এবং সহিহ নিয়ম নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ায় সঠিক নিয়মে একটি মাসহাফ তৈরির পর অন্যান্য সকল মাসহাফ পুড়িয়ে ফেলা হয়। বর্তমানে আমরা যে টাইপগুলোর কথা বলি তা'র সবগুলোই আসলে 'উসমানী মাসহাফের কুরআন' অর্থাৎ উসমান (রা:) যে মাসহাফ তৈরি করেছিলেন সেই মাসহাফ। শুধুমাত্র পড়া সজহতর করা'র জন্যে অঞ্চল ভিত্তিক একেক টাইপে যেমন, নূরানী (কোলকাতা টাইপ), ইন্দো-পাক (লক্ষ্ণৌ টাইপ) ও হাফেজী টাইপে ভিন্ন ভিন্ন ফন্ট ব্যবহার ও মূল উসমানী মাসহাফের তুলনায় মাদগুলো'কে একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু উভয় টাইপের শব্দ, বাক্য ও উচ্চারণ একই। এখানের আলোচনার বিষয়বস্তু শুধু ভিন্নভাবে উপস্থাপনাটুকু নিয়েই, যেন নূরানী বা ইন্দো-পাক টাইপ থেকে কুরআন শিখেছেন এরকম যে কেউ সহজেই সৌদি আরব টাইপের (মদীনা মাসহাফের) কুরআন পড়তে পারেন।

নূরানী ও সৌদি আরব টাইপ কুরআনের উল্লেখ্যযোগ্য পার্থক্যসমূহ

দুই টাইপের কুরআনে বেশ কিছু পার্থক্য থাকলেও যারা নূরানী অথবা ইন্দো-পাক টাইপ থেকে কুরআন শিখেছেন, কিন্তু এখন সৌদি আরব টাইপের কুরআনও পড়তে চান, তারা নীচের পার্থক্যগুলো জেনে নিলে সহজেই তা পারবেন ইনশা'আল্লাহ। উভয় টাইপের লক্ষ্যনীয় পার্থক্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন ফন্ট ব্যবহার, হামযাতুল ক্বত্বআ' ও হামযাতুল ওয়াসলে চিহ্ন ব্যবহার, এবং মাদগুলোকে একটু ভিন্ন রকমভাবে উপস্থাপন করা।

১) ফন্ট

নূরানী টাইপে ব্যবহার করা হয়েছ 'নূরানী' বা 'কলকাতা' টাইপ ফন্ট অপরপক্ষে সৌদি আরব টাইপে (মদীনা মাসহাফে) ব্যবহার করা হয়েছে 'নাকশ' নামক একটি ফন্ট। নীচে সূরা ফাতিহার প্রথম আয়াতটি উভয় ফন্টে দেয়া হলো, ভালভাবে প্রতিটি অক্ষর মিলিয়ে দেখুন।

নূরানী ও নাকশ ফন্টের পার্থক্য


২) হামযা'য় চিহ্ন ব্যবহার

আরবী ভাষায় দুটি হামযা আছে একটিকে হামযাতুল ওয়াসল (هَمْزَةُ الوَصَلْ) ও অপরটিকে হামযাতুল ক্বত্বআ (هَمْزَةُ الْقَطَع) বলা হয়। সৌদি আরব টাইপ কুরআনে 'হামযাতুল ওয়াসল'-এর উপরে ص  'ষদে'র শুধু  মাথার অংশটুকু কুরআনে যা এরকমদেখায় এবং 'হামযাতুল ক্বত্বআ'তে  ع 'আঈনে'র শুধু মাথার অংশটুকু      দিয়ে, কুরআনে যা এরকমহামযাতুল ক্বত্বা দেখায় বোঝানো থাকে কোনটা কোন হামযা কিন্তু নূরানী টাইপ কুরআনে হামযাতুল ওয়াসল  হামযাতুল ক্বত্বআ কোনো রকম চিহ্ন দিয়ে বোঝানো থাকে না। বাক্যের শুরুতে ও ভিতরে যে খালি আলিফ থাকে  সেটাই হামযাতুল ওয়াসল আর যে হামযাতে সবসময়ই যের যাবার ও পেশ থাকে সেটাই হামযাতুল ক্বত্বআ।

৩) নীরব অক্ষরে ছোট গোল চিহ্ন

সৌদি টাইপ কুরআনে বিভিন্ন আয়াতের মধ্যে আলিফ এবং অয়াও অক্ষরের উপর একটি গোল চিহ্ন দেয়া থাকে, এগুলো নীরব অক্ষর, এগুলোর কোনো উচ্চারণ করা যাবে না। উদাহরণস্বরুপ এই ও     শব্দ দুটিতে দেখুন আলিফঅয়াও এর উপর  গোল চিহ্ন (লাল) দেয়া আছে। কিন্তু নূরানী টাইপ কুরআনে এরকম কোনো চিহ্ন দেয়া থাকে না তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলিফের উপর গোল চিহ্ন দেয়া থাকে যেগুলোকে আলিফ জাইদা বলা হয়।
 

৪) নূরানী ও সৌদি আরব টাইপ কুরআনে মাদগুলো যেরকম দেখায়

আমরা জানি নূরানী টাইপে মাদে আসলী মানে যাবারে'র বামে খালি আলিফ, পেশে'র বামে অয়াও সাকিন এবং যেরে'র বামে ইয়া সাকিন, সৌদি আরব টাইপেও তাই শুধু পেশে'র বামে অয়াও সাকিনের সাকিন নেই আর যেরে'র বামে ইয়া সাকিনের সাকিন নেই। তাহলে সৌদি আরব টাইপে মাদে আসলীর রুপ হচ্ছে, যাবারে'র বামে খালি আলিফ, পেশে'র বামে খালি অয়াও এবং যেরে'র বামে খালি ইয়া। আর খাড়া যাবারে'র পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে দুটি যাবার, একটি সাধারণ যাবার আর তার পাশে একটি খাড়া যাবার, খাড়া যেরে'র পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে যেরে'র বামে একটি ছোট ইয়া (নোকতা বা দুই ফোটা ছাড়া ইয়া) এবং উল্টা পেশের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে পেশে'র বামে একটি ছোট অয়াও। নীচে উভয় টাইপ কুরআনে মাদে আসলীর রুপ মনোযোগ বোঝার চেষ্টা করুন।

নূরানী ও সৌদী আরবের মদীনা মাসহাফের কুরআনে মাদে আসলীর পার্থক্য

উভয় টাইপ কুরআনের আয়াতে মাদে আসলী'র রুপ:


এছাড়া অন্যান্য মাদ এবং ৩ ও ৪ আলিফ মাদ নির্দেশক চিহ্ন উভয় টাইপের কুরআনে একইরকম।

৫) নুন ও মীম সাকিনে সাকিনের অনুপস্থিতি

সৌদি আরব টাইপে নুন সাকিনের ইখফা, ইদগমইকলাবের অক্ষরগুলোর পূর্বের নুন অক্ষরে এবং মীম সাকিনের ইখফা'র অক্ষর 'বা' এর পূর্বের মীম অক্ষরে সাকিন দেয়া থাকে না। সেক্ষেত্রে পাঠকারীকে অবশ্যই ইখফা, ইদগম ও ইকলাবে'র অক্ষরগুলো সম্বন্ধে জানা থাকতে হবে। উদাহরন স্বরুপ (কুনতুমবিহী-) শব্দটি লক্ষ্য করুন, নীল নুন ও মীমে'র উপরে সাকিন নেই, কারণ? নুনে'র পরের লাল 'তা' নুন সাকিনের ইখফার অক্ষর এবং মীমে'র পরের লাল 'বা' মীম সাকিনের ইখফার অক্ষর। সুতরাং এখন নুন ও মীমে সাকিন ধরে গুন্নাসহ ইখফা'র নিয়মে পড়তে হবে কুং-তুম-বিহী-। নুন সাকিন পড়ার নিয়মগুলো পুনরায় ভালভাবে জেনে নিন এই লিংক থেকে আর মীম সাকিন পড়ার নিয়ম এই লিংক থেকে।

৬) তাশদীদ ছাড়া নুন সাকিনের ইদগমে'র অক্ষর

নূরানী টাইপ কুরআনে ইদগমের অক্ষরগুলোতে তাশদীদ দেয়াই থাকে তাই ইদগম সম্বন্ধে খুব জানা না থাকলেও তা পড়া যেতে পারে, কিন্তু সৌদি টাইপ কুরআনে ইদগমের অক্ষরগুলোতে তাশদীদ দেয়া থাকে না, তাই তা পড়ার জন্যে নুন সাকিনের ইদগম সম্বন্ধে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে। 

সহজভাবে মনে রাখুন যে নুন সাকিনের ইদগমের ৬টি অক্ষর  ل ر ن م و ي  যদি সৌদি টাইপ কুরআনে খালি বা ফাঁকা নুনে'র বামে থাকে তাহলে এই অক্ষরগুলোর উপর তাশদীদ থাক আর না থাক (অয়াও এবং ইয়া ছাড়া অন্য অক্ষরগুলোতে তাশদীদ থাকতে পারে) তাশদীদ ধরে পড়তে হবে এবং নুনে'র আর কোনো উচ্চারণ করা যাবে না। এই ৬ অক্ষরের মধ্যে ن م و ي  গুন্নাসহ উচ্চারণ করতে হবে এবং ل ر গুন্না ছাড়া। উদাহরণস্বরুপ এই শব্দটি    দেখুন নীল খালি নুনে'র বামে তাশদীদবিহীন লাল ইদগমের অক্ষর। ইদগম সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনার জন্যে এই লিংকে দেখুন

৭) ইখফা ও ইদগমের অক্ষরে পরিবর্তিত রুপে তানবীন

তানবীনের (দুই যাবার, দুই যের, দুই পেশ) নুন সাকিনের পর যদি ইখফা অথবা ইদগমের অক্ষর থাকে তাহলে সৌদি কুরআনে তানবীনের রুপ পরিবর্তন করা হয়, উদাহরনস্বরুপ, যদি তানবীনের বামে ইখফা অথবা ইদগমের অক্ষর না থাকে তাহলে তানবীনের নিম্নোক্ত রুপ ব্যবহার করা হয়
আর যদি তানবীনের বামে ইখফা ইদগমের অক্ষর থাকে তাহলে উপরোক্ত রুপ পরিবর্তন করে নিম্নোক্ত রুপ ব্যবহার করা হয়
কিন্তু নূরানী কুরআনে সব অবস্থাতেই তানবীনের একই রুপ ব্যবহার করা হয়।

৮) ইকলাবের অক্ষরেও পরিবর্তিত রুপে তানবীন

তানবীনের (দুই যাবার, দুই যের, দুই পেশ) পর যদি নুন সাকিনের ইকলাবের অক্ষর ب 'বা'  থাকে তাহলে সৌদি আরব টাইপ কুরআনে তানবীনের এই রুপ পরিবর্তন করে এক যাবার, এক যের ও এক পেশের সাথে একটি মীম অক্ষর ব্যবহার করা হয় যা এরকম দেখায়। উদাহরনস্বরুপ এই শব্দটি দেখুন নীল 'বা' অক্ষরের জন্যে তানবীনের পরিবর্তিত রুপ ব্যবহার করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, সূরার শেষ শব্দেও এরকম মীম দেয়া তানবীন দেখা যেতে পারে কারণ দম না ছেড়ে পরের সূরা পড়তে চাইলে প্রথম অক্ষর 'বিসমিল্লাহ'র ب 'বা' হয়। অন্যদিকে নূরানী কুরআনে ইকলাবের অক্ষরে তানবীনের কোনো রুপ পরিবর্তন করা হয় না, তবে কোনো কোনো কুরআনে তানবীনের পাশে ছোট্ট একটা 'মীম' দিয়ে ইকলাব নির্দেশিত করা থাকে। ইকলাব কি এবং কিভাবে তা পড়তে হয় জানার জন্যে এই লিংকে দেখুন।

৯) সিজদা চিহ্নের পার্থক্য

নূরানী কুরআনে সিজদা'র আয়াতের শেষে ও ডান অথবা বাম পাশে মার্জিনের বাইরে লিখা থাকে 'সিজদা', অন্যদিকে সৌদি আরব টাইপে আয়াতের শেষে কিছু না লিখে সিজদা'র শব্দটির উপর এইরকম একটা দাগ দেয়া থাকে এবং ডান অথবা বাম পাশে মার্জিনের বাইরে লিখা থাকে سَجْدَة (সাজদাহ)

উপরোক্ত পার্থক্যসমূহ ছাড়াও উভয় টাইপের মধ্যে আরো কিছু পার্থক্য আছে যেগুলো খুব জটিল বা বড় কোনো পার্থক্য নয় যেমন, সৌদি আরব টাইপে রুকু চিহ্নসহ বেশ কয়েকটা অয়াকফ চিহ্ন ব্যবহার করা হয়নি, ৩০ পারা'র একেক পারা'কে ২ অংশে ভাগ করে গঠন করা হয়েছে ৬০টি 'হিজব' (الحِزْب) আবার একেক হিজব'কে ৪ ভাগে ভাগ করা হয়েছে, অন্যদিকে নূরানী কুরআনকে ৫৪০ রুকু, ৩০ পারা ও ৭ মঞ্জিলে বিভক্ত করা হয়েছে। এছাড়া উভয় টাইপ কুরআনের মধ্যে আর তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

১০) আরবী ভাষায় সূরা'র নাম ও আয়াত নাম্বার

সৌদি আরব টাইপ কুরআনে সূরা'র নাম ও আয়াত নাম্বারগুলো আরবীতে লিখা থাকে, তাই পাঠকারীকে নুন্যতম আরবী সংখ্যা সম্বন্ধে জানা থাকতে হবে, যেন অর্থ বা তাফসীর জানার প্রয়োজন হলে সহজেই আয়াত নাম্বারগুলো দেখে নিতে পারেন। নীচে ০ থেকে ৯ পর্যন্ত বাংলা সংখ্যার পাশে আরবী সংখ্যাগুলো দেয়া হলো।  




অনুশীলন

উপরে যে ১০টি পার্থক্য আলোচনা করা হলো সুত্র হিসাবে সেগুলোর রং চিহ্নিত নাম্বার উল্লেখ পূর্বক নীচে সৌদি আরব টাইপ কুরআন থেকে কিছু আয়াত দেয়া হলো। পার্থক্যগুলো বুঝে পড়ার চেষ্টা করুন। কোনোটি বুঝতে না পারলে দেখুন সেটা'র রং কত নাম্বার পার্থক্যের, তারপর সে অনুযায়ী উপরের আলোচনা থেকে সেই নাম্বারের পার্থক্যটি পুনরায় পড়ে নিন।




পার্থক্যগুলো রং চিহ্নিত ছাড়া দ্রুত সনাক্ত করতে অভ্যস্ত হওয়ার জন্যে পর্যায় ক্রমিকভাবে নীচের অনুশীলনগুলো করুন।

১) সূরা ফাতিহা (পরিকল্পনাধীন)
২) সূরা হুমাযাহ (পরিকল্পনাধীন)
৩) সূরা ফিল (পরিকল্পনাধীন)
৪) সূরা কুরইশ (পরিকল্পনাধীন)
৪) সূরা মাঊন (পরিকল্পনাধীন)
৫) সূরা কাওসার (পরিকল্পনাধীন)
৬) সূরা কাফিরুন (পরিকল্পনাধীন)
৭) সূরা নাসর (পরিকল্পনাধীন)
৮) সূরা লাহাব (পরিকল্পনাধীন)
৯) সূরা ইখলাস (পরিকল্পনাধীন)
১০) সূরা ফালাক্ব (পরিকল্পনাধীন)
১১) সূরা নাস (পরিকল্পনাধীন)


Share: